মো:জাহিদ হাসান: আফগানিস্তানকে হারিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে নিজেদের সেরা জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। গতকাল সফরকারী আফগানিস্তানকে ৫৪৬ রানে বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে ক্রিকেটে এই শতাব্দীর সবচেয়ে বড় জয় তুলে নিয়েছে টাইগাররা। টেস্ট ইতিহাসে রান হিসেবে এটিই সবচেয়ে বড় জয় বাংলাদেশের। ফলে এই জয়ে টেস্ট ক্রিকেটে স্মরণে রাখার মতো একটা নজির স্থাপন করলো বাংলাদেশ। ২০০০ সালে টেস্ট খেলার যোগ্যতা অর্জন করা বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ১৩৮ টি ম্যাচ খেলেছে। তার মধ্যে কেবল ১৮টি ম্যাচ জিততে পেরেছে। হেরে যাওয়া ম্যাচগুলোর অধিকাংশই ছিল ইনিংস ব্যবধানে পরাজয়। সেই বাংলাদেশ ৪ দিনে আধিপত্য দেখিয়ে ক্রিকেট খেলে জয় পেয়েছে রেকর্ড গড়ে। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৫৪৬ রানের বিশাল এই জয়কে কেবলমাত্র ‘জয়’ হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এটা দেশের জন্য আরো অনেক বড় কিছু। টেস্ট ক্রিকেটে সাফল্য পেতে বোলারদের ২০ উইকেট নেওয়ার বিকল্প নেই। কিন্তু দল হিসেব বেশিরভাগ সময় ২০ উইকেট নিতে ব্যর্থ হচ্ছিলেন টাইগার বোলাররা। কিন্তু সাকিব-তামিমকে ছাড়া লিটনের নেতৃত্বে আফগানিস্তানের ব্যাটারদের নিয়ে ছেলেখেলা করেছে টাইগার বোলাররা। প্রথম ইনিংসে তাদের ১৪৬ রানে রুখে দেওয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসেও ১১৫ রানের বেশি যেতে দেননি। যার মূল কৃতিত্ব তাসকিন, এবাদত, শরিফুলদের। আক্রমণের এই ত্রয়ী আফগানিস্তানের কঠিন পরীক্ষা নিয়েছেন। বোলারদের পাশাপাশি বাংলাদেশের ব্যাটাররাও আলো ছড়িয়েছেন রীতিমত। আফগান বোলারদের পাড়ার বোলার বানিয়ে ছেড়েছেন শান্ত-মুমিনুলরা। এভাবে ডমিনেট করা জয়ের পর টেস্ট ক্রিকেট এটাকে বাংলাদেশের নতুন শুরু বলাই যায়। অবশ্য এই নতুন শুরুর আগে ২০১৯ সালে চট্টগ্রামে আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে ২২৪ রানে হারের পর কঠোর সমালোচনার মুখেও বাংলাদেশকে পড়তে হয়েছিল। স্পিন বান্ধব উইকেট বানিয়ে ফাঁদ পাতা হলেও সেই ফাঁদে পা দিয়েছিল নিজেরাই। পরে রশিদ খানের ঘূর্ণিজাদুতে অসহায় আত্মসর্মপণ করে সাকিব আল হাসানের দল। এবার ঢাকা টেস্টে সবুজ ঘাসে পেস বান্ধব উইকেট বানানোর পরও সংশয় ছিল। নিজেদের পাতা ফাঁদে নিজেরাই আবার পা দেয় কিনা। কিন্তু দেখা গেলো প্রত্যাশার চেয়েও বেশি কিছু পেয়েছে টাইগাররা। অবশ্য টস হারটাই বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। এর আগে ২০০৫ সালে চট্টগ্রামে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২২৬ রানে জিতেছিলো টাইগাররা। সব মিলিয়ে টেস্ট ইতিহাসে রান বিবেচনায় তৃতীয় বড় জয়ের নজির গড়লো বাংলাদেশ। টেস্ট ইতিহাসে প্রথম দু’টি বড় জয় ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার। ১৯২৮ সালে ব্রিজবেনে ইংল্যান্ড ৬৭৫ রানে অস্ট্রেলিয়াকে এবং ১৯৩৪ সালে ওভালে অস্ট্রেলিয়া ৫৬২ রানে হারিয়েছিলো ইংল্যান্ডকে। টেস্ট ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জয়ে এটি তৃতীয় সেরা। এতদিন তৃতীয় বড় জয় ছিলো ৫৩০ রানের। ১৯১১ সালে মেলবোর্নে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৫৩০ রানে হারিয়েছিলো অস্ট্রেলিয়া। ১১২ বছর পর অস্ট্রেলিয়ার সেই রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়ে নিজেদের জয়কে তৃতীয়স্থানে তুললো বাংলাদেশ। মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ৬৬২ রানের টার্গেটে তৃতীয় দিন শেষে ২ উইকেটে ৪৫ রান করেছিলো আফগানিস্তান। ৮ উইকেট হাতে নিয়ে আরও ৬১৭ রান দরকার ছিলো আফগানদের। গতকাল চতুর্থ দিনে পেসার তাসকিন আহমেদের ক্যারিয়ার সেরা ৩৭ রানে ৪ উইকেট দখলের সুবাদে বাংলাদেশকে খুব বেশি ঘাম ঝড়াতে হয়নি। দিনের তৃতীয় ওভারে বাংলাদেশকে প্রথম সাফল্য এনে দেন পেসার এবাদত হোসেন। ৫ রান নিয়ে শুরু করে এবাদতের বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন নাসির জামাল। ৬ রান করেন তিনি। কিছুক্ষণ বাদে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় উইকেট উপহার দেন পেসার শরিফুল ইসলাম। রহমত শাহর বিপক্ষে বাংলাদেশের ক্যাচ আউটের আবেদনে সাড়া দেন আম্পয়ার। কিন্তু রিভিউ নিয়ে নিজের উইকেট বাঁচান রহমত। রহমতকে শিকার করতে না পারার দুঃখ দ্রুতই ভুলে যান শরিফুল। আফগানিস্তানের উইকেটরক্ষক আফসার জাজাইকে ৬ রানে বিদায় দেন তিনি। গালিতে মেহেদি হাসান মিরাজকে ক্যাচ দেন জাজাই। জাজাইর বিদায়ে কনকাশনে যাওয়া আফগানিস্তানের অধিনায়ক হাসমতুল্লাহ শাহিদির পরিবর্তে খেলতে নামেন বাহির শাহ। আগের দিন পেসার তাসকিনের বাউন্সারে হেলমেটে আঘাত পেয়ে আহত অবসর নিয়েছিলেন শাহিদি। শেষ পর্যন্ত ১৩ রানে থেকেই কনকাশন হলেন শাহিদি। ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মত টেস্ট খেলতে নেমে শরিফুলের বলে ব্যক্তিগত ৭ রানে আউট হন বাহির। ২৫তম ওভারে গতকাল প্রথমবারের মত বোলিংয়ে আসেন আগের দিন ১ উইকেট নেয়া তাসকিন। এরপর আফগানিস্তানের তিন ব্যাটারকে শিকার করে বাংলাদেশকে জয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌছে দেন তাসকিন। রহমত শাহকে ৩০, করিম জানাতকে ১৮ ও আহমাদজাইকে ১ রানে শিকার করেন তিনি। মাঝে হামজা ৫ রানে মিরাজের শিকার হলে ১১০ রানে ৯ উইকেটে পরিনত হয় আফগানিস্তান। তাসকিনের বলে আফগানদের শেষ ব্যাটার জহির খান হাতে ব্যথা পেয়ে আহত অবসর নিলে ১১৫ রানে গুটিয়ে যায় আফগানিস্তান। এছাড়া শরিফুল ২৮ রানে ৩টি, মিরাজ-এবাদত ১টি করে উইকেট নেন। টেস্টের প্রথম দিনে টস হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে আফগান বোলারদের নিয়ন্ত্রণহীন বোলিংয়ের সুযোগ নিয়ে ৩৮২ রান করে বাংলাদেশ। প্রথম ইনিংসের তুলনায় দ্বিতীয় ইনিংসে আফগানরা ভালো বোলিং করলেও বাংলাদেশের ব্যাটারদের রুখতে পারেননি। বরং আফগানদের ফলোঅন না কারিয়ে ৪ উইকেটে ৪২৫ রানের পাহাড় গড়ে ঘোষণা করে দ্বিতীয় ইনিংস। তাতে ৬৬২ রানের পুঁজি পেয়ে যায় লিটন দাসের দল। ব্যাটিং বিভাগে সবচেয়ে স্বস্তির বিষয়টি ছিল মুমিনুলের রানে ফেরা। গত ২৬ ইনিংসের মধ্যে এবারই তিন অঙ্কের ঘরে পৌঁছাতে পেরেছেন তিনি। মুমিনুলকে পাশে রেখে নাজমুল হোসেন শান্তও টানা দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি করে মুমিনুলের কীর্তিতে ভাগ বসিয়েছেন। এক সময় যে শান্তকে নিয়ে সমালোচনা হতো, সেই শান্তই এখন নিয়মিত পারফর্মার। ব্যাটারদের ছাপিয়ে এই টেস্টে সবার নজর ছিল বোলারদের দিকে। বিশেষ করে সবুজ উইকেটে বাংলাদেশের পেসাররা কেমন করেন সেটাই ছিল দেখার। সেখানে ভালো করেছেন তিন পেসারই। আফগানিস্তানের ১৯ উইকেটের মধ্যে ১৪টি শিকার করেছেন তাসকিন, শরিফুল, এবাদতরা। যা এক ম্যাচে বাংলাদেশের জন্য সর্বোচ্চও! তাসকিন প্রথম ইনিংসে ভালো বোলিং করতে না পারলেও দ্বিতীয় ইনিংসে দারুণ বোলিং করে শেষ পর্যন্ত ক্যারিয়ার সেরা ৪ উইকেট নিয়েছেন। পেতে পারতেন ৫টিও! শুরুতে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সুযোগ এসেছিল এবাদতেরও। কিন্তু শুক্রবার এবাদতকে চার উইকেট নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। গতকালতাসকিনের সামনেও সুযোগ ছিল ১৩ বছরের খরা কাটানোর। পরে হতে হতেও হয়নি। তাদের পাশাপাশি নিজের প্রতিভা দেখিয়েছেন শরিফুল ইসলামও।